Saturday, October 22, 2011

খেয়াল

১। হুপো



গত দু'দিন তাকে দেখেছি বাড়ীর পুকুর পারে মার কাছে শুনেছি এসেছে বাড়ীর ভিতরেও আজ দেখলাম ঢুকেছে আমার ঘরে। অবাক হলাম তার আচরণে বাড়ীর লোকজন জানালো আগে কখনো এত কাছাকাছি আসতে  দেখেনি এই পাখিকে এক বছর হলো পাখিটিকে আমি অন্য রকম ভালোবাসি আমার দেখা দিতে এসে সে ভীষণ নাড়া দিয়ে গেলো


২০০৫ সাল চাকরি নিয়ে ঢাকা ছাড়লাম। মনে খুব কষ্ট পেয়েছি, ঢাকায় থাকাটা মনে হয়েছে জরুরী রাজনীতি আর মুক্ত জীবনের জন্য মনে করতাম শহরই যুতসই  গ্রামীণ জীবনে দূষণ মুক্ত পরিবেশ আছে, মানুষের জীবন প্রণালীর ভিন্নতা আছে, মানুষ প্রকৃতির সাথে আছে সেই সূত্রে একটি সম্পর্কও আছেসকল মানুষ সকলকে চিনে বলা যায় বংশ পরম্পরায় ফলে হৃদ্যতার সাথে তৈরী হয় বংশানুক্রমিক ঝগড়া ফ্যাসাদ মুক্ত জীবন চর্চা ব্যাহত হয় মারাত্নকভাবে শহরে আপনাকে দেখার কেউ নেই গ্রামে আপনাকে দেখছে সকলেই নানাবিধ ভাবনার দোলাচালে চলে এলাম মফস্বলে


চাকরিস্থল আমার বাড়ী থেকে ৮০ কিলোমিটারথানা শহর গ্রামীণ পরিবেশ প্রথম প্রথম আমার একদমই ভালো লাগতো না সুযাগ পেলেই চলে যেতাম বাড়ীতে  

                         'বাড়ীটি মোর এমন জায়গায়
                         যেখানে পাহাড় এসে সমতলে মিলায়
                         কাঞ্চনজঙ্ঘা, সে তো দৃষ্টি সীমায়'

অফুরন্ত সময় একটি গ্রামে কাটাই, শৈশব কৈশোরের চেনা জায়গা, বাবা মা পরিবারের লোকজন, ছোট্ট ভাতিজি অবনি আর টুকটাক পড়ালেখা মনের স্থৈর্যতা ছিলনা কেমন জানি টান অনুভব করতাম ঢাকা শহরের


বেশীর ভাগ সকাল-বিকাল যেত নদীর ধারে চাভই নদী পাহাড়ী নদী কাকচক্ষু জল নিয়ে ঝরণার মতো বয় সকালে রাতচরা পাখিদের ঘরে ফেরা, দিনের পাখিদের কলোরব, লাল টুকটুকে সূর্যি মামার মোলায়েম আলোর বিচ্ছুরণ, আর গ্রামের বালক বালিকা বা বধুদের গরু-ছাগল নিয়ে নদীর ডাঙ্গায় গমনে যেন আড়মোড়া দিয়ে উঠে প্রতিবেশ সন্ধ্যায় দিগন্তে ডানা মেলে পাখিদের ঘরে ফেরা, দু'একটা টুনি বগের শেষ মাছটি শিকারের অপেক্ষায় চুপটি মেরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, গাছের আড়ালে রবির ঢাকা পড়া, কি কারণে জানিনা অনেক বাঁশঝাড় থাকার পরেও কোন নির্দিষ্ট বাঁশঝাড়ে হাজারে হাজারে গো শালিকের কিচির মিচির যেন লক্ষী পেচার ঘুম জাগানিয়া সারা বছর নদীতে কমবেশী পানি থাকে খুব ছোট্ট নদী হওয়ায় জল-জল্লাদ ভারতের প্রত্যক্ষ কবলে পড়েনি নব ফেরাউনদের কবলে পড়ে বাংলা বা পদ্মা মেঘনা যমুনা আজ মৃত্যু শয্যায় অবাক হয়েছি মৃত পুনর্ভবা নদী দেখে তাই বলছিলাম নদীতে সারা বছর কিছুনা কিছু পানি থাকে নদীর দু'ধারের মানুষের জীবনের এক অচ্ছেদ্য অংশ এই নদী অদ্বৈতমল্ল বর্মনের 'তিতাস একটি নদীর নাম' যে তিতাসের কথা বলা হয়েছে চাভই তারই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ


সকালবেলা নদী এলাকায় হাঁটছি হঠাৎ চোখে পড়লো হুপো বা মোহনচুড়া পাখিটিকে আমি ছোটবেলায়ও দেখেছি আজ কড়া টান টানছে সন্মোহিনী ভেলকি লাগিয়েছে, তাকিয়ে ছিলাম অপলকে ডোরাকাটা শরীর লম্বা ঠোট যত লম্বা ঠোট তত লম্বা তার ঝুটি ঝুটিওয়ালা পাখি দেখেছি যেমন বুলবুলি হুপোর ঝুটিটি যেন রূপপুর দু'পাশে বাত্তি লাগানো তালপাখার মতো, বন্ধ করতে পারে খুলতে পারে দু'তিনবার  দৃশ্য দেখে চটকে মাতার দশা কাছে গেলাম ঝুটি বন্ধ করে উড়াল দিল ডোরাকাটা ডানা দিগন্তে মেলে ধরে ঢেউ খেলানো সাইনসয়ডাল উড়া একবারে বেশী দূরে যায় না অল্প অল্প করে উড়ে কিছুদুর গিয়ে থেমেই লম্বা চঞ্চু দিয়ে একমনে খাবার খোচাতে লাগলো হুপোর আমন্ত্রণে সারা দিলাম


ঢাকা গিয়ে সলিম আলির 'ইন্ডিয়ান বার্ডস' আর কলেজ থেকে জোগাড় করলাম বাইনোকুলার গ্রামের পাখিদের সাথে কাটালাম কিছুদিন


প্রাণিবিদরা বলে সরীসৃপ থেকে পাখির রূপান্তর তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হাজির নাম হলো-আরকিওপ্টেরিক্স 

ডাইনোসাররা সরীসৃপ, একসময় পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতো পাখি উড়তে পারে, উড়তে পারলেই পাখি হয় না উইপোকাও জীবনে একবার উড়ে, আর খুবই  সাধারণ কথা সবাই শুনেছেন 'পিপিলিকার ডানা গজায় মরিবার তরে' মশা মাছি মৌমাছি ফড়িং প্রেম ঠাকুর ভ্রমর সকলেই উড়ে তাহলে শুধু উড়লেই পাখি হয়না পাখি মেরুদন্ডী এবং উড়ে এতেই গোল ছুটে না, গোল বাঁধায় বাদুড় তাহলে পাখি মেরুদন্ডী, উড়ে এবং ডিম পাড়ে উট পাখি আবার উড়ে না সেক্ষেত্রে যে সব চতুস্পদী প্রাণির সামনের পা ডানায় রূপান্তরিত (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) তারাই পাখি কী অদ্ভুত মিল মানুষের  বেলায় সামনের পা হয়েছে হাত মানুষেরও উড়ার আকাঙ্খা আছে মহাভারত, রামায়ণ বা সোলায়মান নবীর গল্পে বা মিথে পাওয়া যায় উড়ার কথা তবে মানুষ উড়তে গিয়ে বাঁধিয়েছে লঙ্কাকান্ড রবি ঠাকুর পারস্যের পথে হেলিকপ্টারে উড়ার অভিজ্ঞতায় বলেছিলেন যেন পাখির রাজ্য এক কুৎসিত তেলাপোকা আর পাখি, উড়া তার মজ্জাগত

আজ ঠিক ঈদের আগের দিন হুপো আমার বাড়ীতে এসেছিল


পুরান খাতার পাতা থেকে: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬



২। ধলেশ্বরী




শিশু মন জগতকে চিনতে শুরু করার সাথে সাথে উচ্ছলতা প্রকাশের আশ্রয় পেয়েছি নদীতে মায়ের মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য কতবার যে, দীর্ঘ অবগাহনের রক্তিম চোখ স্বাভাবিক বানাতে নদীর ধারে, বটবৃক্ষ তলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি, তার কোন ইয়ত্তা নেই প্রায়ই বিফলে যেত সব প্রচেষ্টা কোন টানে কার গন্ধে রূপে বা রসের আস্বাদনে এই তাড়না? ভাল লাগতো, বাঁধা মানতে চাইতো না মারের ভয়ও ঠেকাতে পারতো না নদীর এই ভালবাসা

তারপর থেকে নদীর জল অনেক গড়িয়েছে কূল ভেঙ্গেছে-গড়েছে, নতুন নতুন চর জাগিয়েছে, পুরনো চর তলিয়ে দিয়েছে সাগরে পতিত জল রূপ পরিবর্তন করে বাষ্প, মেঘ, বৃষ্টি হয়ে অনেকবার পৃথিবীর তেষ্টা নিবিয়েছে জীবন প্রণালীর এক মহাশকটে চড়ে ঘুরছি গ্রাম থেকে শহরে, মা ধরণীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অনেক নদীর দেখা পেয়েছি কিন্তু সেই ছোট্টবেলার নদীটিকে, সেই অজানা ভালবাসা, সেই বোধমুক্ত টান যেন ছিলনা জীবনে

ধলেশ্বরীর ধারে বসে আছি হঠাৎ মনে হলো নদীর জল যেন কোন মানবী হয়ে উঠে আসছে, শীতলক্ষ্যা হয়ে ধলেশ্বরী ধরে আমার দিকে তার আসার শব্দ, গায়ের গন্ধ, চাহনি, হাসি চমক লাগিয়ে দিল ধলেশ্বরী হয়ে উঠলো চাভই বরকা আমার সমস্ত শৈশব কৈশোরের স্মৃতি জাগ্রত হলো, কেমন যেন মনে হোল সবকিছু এলোমেলো ধাতস্ত হয়ে নদীকে বললাম "তুমি দেবী হয়ে এলে' নদী বলল 'লিখে রাখবো তোমার একথা'

শুরু হলো নদীর সাথে চলা, কথা বলা, ভাল লাগা মন্দ লাগা আরও কত কী! প্রিয়তমা নদী, তুমি এমনভাবে আবির্ভূত হতে যে দুঃসাহসী হয়ে তোমার কাছে ছুটে আসতাম তারপর তুমি অসাধারণ- তোমার কথা বলায়, ঢেউয়ের ভাজে ভাজে সুরের মুর্ছনায়জীব জড়ের রস দানের উদারতায়, তোমার ভাললাগার চমৎকারিত্বে, তোমার জেদে আমি বিমোহিত সত্যি তুমি কত রঙ্গ জান!

নদীজালে আচ্ছাদিত দ্বীপের মানুষ কতভাবেই না চিনে তোমাকে তুমি কার জন্য কীভাবে আবির্ভূত তা বোধ করা মুশকিল তুমি কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছ, কত মানষকে নিরাশ্রয় বানিয়েছ, কত মানুষের অন্ন যুগিয়েছ, তুমি মানুষের সভ্যতার চারণভূমির সহচরী তুমি মানব জাতিকে পরিচিত হওয়ার জন্য বুক পেতে ধরেছ চলাচলের পথ হয়ে, নিজের পেটের ভিতর ধারণ করেছ মীন সহ অসংখ্য জীব তোমাকে তবুও দুঃখ নামে কিংবা আশীর্বাদ নামে ডাকা যায় না তুমি যে উভয়ই তোমাকে বা প্রকৃতিকে চেনার আজাতি আকাঙ্খা মানুষের তুমি অবগুন্ঠন মুক্ত হয়ে দেখা দাও প্রিয়ত'মা'

পুরান খাতার পাতা থেকে: ২৪ এপ্রিল ২০০৭




৩। বৃষ্টি


তৃষ্ণার্ত প্রকৃতি মেঘের দেখা পেয়েছে হিমালয়ের শিখর থেকে প্রিয়তমা কৃষ্ণকলি দেখা দিয়েছে, মিলনের পূর্বে ঢাকা পড়েছে সূর্য সূর্য্যি মামার বিচ্ছুরিত আলোর রেশ মৃদু মন্দ আভার মত বিরাজিত, উত্তর থেকে শীতল বায়ু ধরাকে শান্তির পরশে করেছে উদ্বেলিত না শীত না গরম, জ্যৈষ্ঠের এই দাবদাহের পর কৃষ্ণকলির আগমন নিয়ে এসেছে এমনি আমেজ গুড়ু গুড়ু মৃদু মন্দ ছন্দে জলধি প্রকাশ করছে তার উচ্ছাস সাথে সাথে একটা দমকা মতো হাওয়া, যা আবার কালবৈশাখীর মতো লোকালয়ের ক্ষতির কারণ নহে, এসে এলোকেশী অবনির কেশ দুলিয়ে যায় বাতাসে জলের ছোঁয়া বাড়াতে শীতল আমেজ টের পাইয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির আগমন আয় বৃষ্টি ঝেপে

ফিঙে পাখিটি ডাবগাছে আশ্রয় নিয়েছে, স্কুলের মাঠের কোলাহলরত ছেলেমেয়েরা রুমে উঠে গিয়েছে বাঁশের তৈরী সাঁকো দিয়ে ত্রস্ত পায়ে দু'একজন পার হচ্ছে সকলে ছাদের নিচে গেলো, বৃষ্টি কা্উকে বা লাগিয়ে দিলো হালকা পরশ থেমে থেমে মোলায়েম হাওয়ায় এমন দোলা যেন মেঘ আর পৃথিবী শীৎকার তুলেছে তার গুড়ু গুড়ু ডাকে পাশেই ভীষন আলসে কড়ই গাছটা সূর্য্যি মামা নেই ভেবে নাকি লজ্জায় ঘুম দিয়েছে এক ফালি পাটক্ষেত হাওয়ার দেয়া পাটে দক্ষিণ যাত্রামুখী হয়ে সজ্জিত হচ্ছে বর্ষার মহামিলন ক্ষণে হঠাৎ ঝিলিক মারলো হলদে আভার মতো, ছেলেমেয়েরা চিৎকার দিয়ে উঠলো, গর্জে উঠলো আকাশ, ঝলকিত হাসির তালে যেন পটকা ফোটানো বৃষ্টি এলো, কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো পরিস্থিতিকে পাল্টে রসে সিক্ত করতে থাকলো এবং সিক্ত গাছ ,মাটি, কাদা, জমে উঠা পানি, মেঘের নাদ, হালকা হাওয়া সর্বোপরি প্রায় নিরব হয়ে আসা মানুষ পশুপাখির আওয়াজ শুধু বৃষ্টির শব্দ, কী সরব তার উপস্থিতি! সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে আজ মিলনের রস নিঃসৃত হচ্ছে, রসের রসায়নে জীবন তৈরী হয়, জীবন বেঁচে থাকে যে জীবনের রস, প্রকৃতির রস

ঝম...... বৃষ্টি
থৈ থৈ অবনি
গোল গোল ফোটা
রূপা রং যেমনি

আয় তবে ত্বরা করে
অবগাহি ধরণী
তৃষ্ণা মিটিয়ে
আনন্দে চান করি

শুকনো দেহখানি তৃপ্ত করে
পুরনো দিনগুলো রপ্ত করে
সামনে যাবি আয়
আয় ত্বরা করি

পুরান খাতার পাতা থেকে: ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৪



৪। বাঁশ



সবুজ গালিচার মতো ঘাস থেকে থেকে হালকা হাওয়ার দোলা কী জানি কিসের এক আবেদন? সর্বভেদী বাতাস ঘাসের শরীর ভেদ করতে চায় শো শো বাতাসের শব্দ কান পেতে শোনার জন্য মাথা উঁচু করে ঘাস জাপটে ধরে বাতাস দুমড়ে মুচড়ে খুঁজতে থাকে নিজের জায়গা ফুলে ফেপে উঠে ঘাসের সারা দেহ স্বর্গীয় এক সুখানুভূতিতে টান টান হয়ে উঠে শরীর, তাল-মাতাল সখীর কাছে ছুটে আসে অন্য সখীরা যুথবদ্ধ সখীরা এবার দিগন্তে মেলে ধরে নিজেদের মরুৎদেব উথাল-পাথাল করে দিয়ে যায় পরক্ষণেই এলোকেশী বাঁশঝোপ সোজা হয়ে দাঁড়ায় দিবানিশি এই বায়ুকেলির সুখ সুর গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তে আনাচে-কানাচে 

গ্রামের ছেলেরা বায়ুকেলির শানেনুজুলে বাঁশের হিয়ার আনন্দ স্বরের লাই বাঁশ কেটে লয় হাতে মরুতের দেখাদেখি তারাও বায়বীয় এই সুখের আকুল সংস্কৃত আকুল কারো কারো মতে বাতুল শব্দেরই নাকি বাংলা রূপ বা্উল গাঁও গেরামের কালো কালো এই বাউধিয়ারা দু'হাতে বাঁশকে জড়িয়ে ধরে নরম ঠোটের উষ্ণ আলতো ছোঁয়ায় মত্ত হয় বায়ুকেলিতে বাঁশের বাশুড়ী বেজে উঠে বাংলার মানসপটে এই দামাল ছেলেদের রাজা হলো কৃষ্ণ কানু ছাড়া গীত নাই আর বাঁশ বা বাঁশী সেতো কানুর হাতে

কদম আর তমাল তরু তলে এই রাখাল কৃষ্ণরা বাজাইত বাঁশী রাঁধারাই আর গোপীনিদের হৃদয় ছিড়িয়া যাইত সাপুড়েরা বাঁশী ছাড়া তো মনে হয় বাগেই আনতে পারিতো না সাপকে বাঁশীর গুণকীর্তন করিতে গিয়া নিজের অক্ষমতার পরিচয় না দিয়া ক্ষেমা দেই

আসলে বাঁশ এক প্রকার ঘাস কথা শুনিয়া এতই অবাক হইয়াছিলাম যে হুদাই এত কথা পাড়িলাম তার চাইতে আমরা বরঞ্চ শচীন কর্তার কথায় কান দেই ''বাঁশী শুনে আর কাজ নেই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশী"

গৃহস্থালির হেন কোন কাজ খুঁজে পাওয়া দায় যেখানে বাঁশের ব্যবহার নাই খেতে বসে তরকারি, কাটা ছেড়ায় ওষুধ এমনকি শিশুর নাড়ি কাটতে ঘর বাড়ী তৈরী, আসবাব পত্র, বাড়ীর চেকর অর্থাৎ নিরাপত্তা বেষ্টনী, তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠা বানরের অংক কষতে, বলতে গেলে ছাই ফেলার ভাঙ্গা কুলা থেকে পারাপারের বাঁশের সাঁকো পর্যন্ত তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার কথা স্মরণ না করলে তো রীতিমত অন্যায় বাংলার সাথে কী এক নিবিড় সম্পর্ক খাইতে বসতে ঘুমাতে চিকিৎসায় বিদ্রোহে বিপ্লবে বাঁশ বঙ্কিম বহু ক্ষেদ প্রকাশ করেছেন বাংগালী বাঁশের লাঠির ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে বলে দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে বিশাল এক প্যারা বরাদ্দ এই লাঠির শোকে বাঙগালির আজকার এই দুর্গতির প্রধান কারণই নাকি লাঠিকে ছেড়ে দে'য়া

আশেপাশের সব রস চুষে খাওয়ার পরও বাড়ীর সামনে পিছনে গরীবের লাগায় বাঁশ যে তাদের অন্ধের যষ্ঠি মঙ্গার দিনে যখন আর কিছুই নাই তখন এই তো সম্বল বাড়ী ছেয়ে থাকে বাঁশঝাড়ে তাইতো মায়েরা শিশুদেরকে চাঁদ দেখায় বাঁশ বাগানের উপর দিয়ে'বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ' ভূত প্রেতের কী এক অভয়ারণ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন এই বাঁশঝাড়!

বাঁশের যত্ন আত্তি খানিকটা ভিন্ন ঢং এর ফাল্গুন মাসে ঝরা পাতা সব জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দে'য়া সিরুয়া বৈশ্বার দিন ( বৈশাখ) উৎসব করে গোড়ায় নতুন মাটি দে'য়া আর মোগো লক্ষী বিজ্ঞানী খনা বলেছেন ধানের চিটা বাঁশথোপে দে'য়ার কথা অন্য কোথাও দিলে ইঁদুর লাভের চেয়ে লোকসান করে বেশী শিকড়ের অত্যাচারে ইঁদুরও দাঁত বসাতে পারে না বাঁশে যে ইঁদুরের ধারালো দাঁতের আশায় শিশুরা প্রথম দাঁত পড়ার পরে দাঁত বদল করার জন্য খুজে বেড়ায় ইঁদুরের গর্ত সেও থমকে দাঁড়ায়

ইঁদুরের কথা যখন আসল তখন কিছুক্ষণ ইঁদুরের বন্যা নিয়ে প্যাঁচাল পাড়া যাক ছোটবেলায় শুনেছিলাম বাঁশের ফুল ধরলে অমঙ্গল হয় ইতোমধ্যে দু'চার দিন স্কুল কলেজে ঘুরে অল্প বিদ্যার অহমিকায় এই সব গাঁও গেরামের লোকায়ত জ্ঞানকে উড়িয়ে দিতাম এক তুড়িতে কী সব কথা কত কুসংস্কার!! উপনিবেশের জোয়াল কাধ থেকে ফেলে দেওয়ার স্লোগানে কেমন হকচকিয়ে উঠলাম কবি গুরুর কথার ভিন্ন মানে টের পেলাম 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দু পা ফেলিয়া' ইঁদুরের বন্যার ঘটনা এর একটা ভাল নজিরবাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের হিলি সাত কন্যার জুম চাষীরা এর দ্বারা কবলিত প্রতি ১০-১২ বছর অন্তর অন্তর বাঁশের ফুল ধরে এর ফলে ইঁদুরের খাবারের প্রাচুর্যতা দেখা দেয় এমনিতেই ইঁদুরে যে পরিমাণ বাচ্চা উৎপাদন করে অতিরিক্ত খাদ্য পেয়ে সে মাত্রা বেড়ে যায় বহু গুণ বাঁশের ফুল ধরার এই ঘটনাটি ঘটে জুম চাষের কিছু আগে ধান পাকার সময় সাধারণত যে পরিমাণ ইঁদুর থাকার কথা তারচে' বহু বেশী ইঁদুর আক্রমন করে পাকা ধানে উল্লেখিত পুরো অঞ্চলে দেখা দেয় খাদ্যভাব আর অন্য দু'একটা অর্থনৈতিক মন্দাভাব যোগ হলেই দুর্ভিক্ষ এটিই ইঁদুর বন্যা নামে খ্যাত বাঁশের ফুল নিয়ে আসে অশনি সংকেত
ইঁদুর বাঁশের ফল খেলেও পাণ্ডা কিন্তু খায় পুরো বাঁশ শিশুর কোলের এই বাহারী পাণ্ডারা চীনেদেশে ঝমঝম বৃষ্টিতে মচমচ করে কামড়ে খায় বাঁশ মানুষও বাঁশ খায় তবে বাঁশের তরকারি খেয়েছি না বলে 'বাঁশ খাইছি' বললে কিন্তু ভিন্ন মানে দাঁড়ায় সে ক্ষেত্রে পাণ্ডার পৌষ মাস আর মানুষের সর্বনাশ!!