Friday, September 23, 2011

লালনের গান















             ৫৯।

আছে ভাবের তালা সেই ঘরে
যে ঘরে সাঁইজি আমার বাস করে।।

ভাব দিয়ে খুল ভাবের তালা
ওরে দেখবিরে মানুষের খেলা
ও তোর ঘুচে যাবে সকল জ্বালা
দেখলে সেরূপ নিহারে।

ভাবের ঘরের কী মুরতি
ভাবের লণ্ঠন ভাবের বাতি
সেই ভাবের ভাব হলে গতি
অমনি সকল যায় সরে।

ভাব না হলে ভক্তিতে কী হয়
একবার মনে বুঝে দেখ মনরাই
ওরে যার যেমন ভাব সে তেমন হয়
ফকির লালন কয় বিনয় করে।।

২৫ পৌষ ১৪১৮।

********************

           ৫৮।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে-যায়
তারে ধরতে পারলে মনবেড়ী
দিতাম পাখির পায়।।

আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তার।

কপালের ফের নৈলে কী আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোন বনে পলায়।

মন তুই রৈলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঞ্চা বাঁশের
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কেঁদে কয়।।

২৫ পৌষ ১৪১৮।

********************

        ৫৭।

গুরু বস্তু চিনে নেনা
ওরে অপারের কাণ্ডারি গুরু
তা বিনে কেউ কূল পাবে না।।

কী কার্য করিব বলে
এ ভবে আসিয়াছিলে
কী ছার মায়ায় রলি ভুলে
সেকথা মনে প’ল না।

হেলায় হেলায় দিন গেলো
মহাকালে ঘিরে এলো
আর কবে করবি বল
রংমহলে পড়লে হানা।

ঘরে এখন বৈছে পবন
হোতে পারে কিছু সাধন
সিরাজ সাঁই কয় অবোধ লালন
এবার গেলে আর হবে না।।

২৪ পৌষ ১৪১৮।

********************

            ৫৬।

যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে
এমন মানব সমাজ কবে সৃজন হবে।

শুনায়ে লোভেরও বুলি
নেবে না কেউ কাঁধের ঝুলি
ইতর আতরাফ রব তুলি
দূরে ঠেলে নাহি দিবে।

আমীর ফকির হয়ে এক ঠায়
সবার পাওনা পাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই
পাবে কেহ নাহি ভবে।

ধর্ম কুল গোত্র জাতির
তুলবে নাগো কেহ জিগির
কেঁদে বলে লালন ফকির
কে মোরে দেখায়ে দিবে।।

২৪ পৌষ ১৪১৮।

******************** 

            ৫৫।

ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর
আপন খবর যাবি কোথায়
আপন ঘর না বুঝে তুই
বাহির খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।

আমি সত্য না হৈলে কয়
গুরু সত্য কোনকালে
আমি যেরূপ দেখ না সেরূপ
দিন দয়াময়।

আত্মারূপে সেই অধর
সঙ্গী অংশ কলাকার
ভেদ না জেনে বনে বনে
বেড়ালে কী হয়।

আপনারে আপনি না চিনলে
ঘুরবি কত ভূবনে
লালন বলে অন্তিমকালে
নাইরে উপায়।।

২৩ পৌষ ১৪১৮।

********************

         ৫৪।

বল কারে তুই খুঁজিস
ক্ষ্যাপা দেশ-বিদেশে
আপন ঘরে খুঁজলে রতন
পায় অনায়াসে।।

দৌড়দৌড়ি দিল্লী-লাহোর
আপনার কোলে রয় ঘোর
নিরুপালেক সাঁই মোর
আত্মারূপে সে।

যে লীলা ব্রহ্মাণ্ডের উপর
সেই লীলা ভাণ্ড মাঝার
ঢাকা যেমন চন্দ্র আকার
মেঘেরও পাশে।

আপনাতে আপনি চেনা
সেই বটে উপাসনা
লালন কয় আলেক চেনা
হলে হয় তার দিশে।।

২৩ পৌষ ১৪১৮।

********************

            ৫৩।

বসতবাড়ীর ঝগড়া কেজো
আজ অবধি মিটল না
কার গোয়ালে কে ধূমা দেয়
সব দেখি তা না না।।

চোরের ঘরে চোর মারে যার
বসতের সুখ হয় কিসে তার
ভুতের কীর্তি যেমন প্রকার
তেমনি তার বসতখানা।

দেখে-শুনে আত্মকলহ
কর্তাব্যক্তি হত হোল
সাক্ষাতের ধন চোরে গেল
লজ্বাতো যাবে না।

সর্বদয় হাকিমের তরে
আর্জি করি বারে বারে
লালন বলে আমার পানে
একবার ফিরে চাইলে না।।

২৩ পৌষ ১৪১৮।

*********************

           ৫২।

এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা কর ত্বরাই কর এই ভবে।।

অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তর কিছুই নাই
দেব-দেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম লৈতে মানবে।

কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মনরে পেয়েছ এই মানব তরণী
বেয়ে যাও ত্বরাই তরী
সুধা রয় যেন ভরা না ডুবি।

এই মানুষে হবে মাধুর্য ভজন
তাইতে মানব রূপ গঠল নিরঞ্জন
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার
অধীন লালন তাই ভাবে।।

২৩পৌষ ১৪১৮।

********************
              ৫১।

দিনে দিনে হোল আমার দিন আখেরি
আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম
তাইতো সদাই আমি ভেবে মরি।

বসত করি দিবারাতে
ষোলজন বোম্বেটের সাথে
দেয় না যেতে সরলপথে
পদে পদে করে দাগাদারি।

বাল্যকাল খেলায় গেলো
যৌবনে কলঙ্ক হোল
বৃদ্ধকাল সামনে এলো
মহাকাল হোল অধিকারী।

যে আশাতে ভবে আশা
তাতে হোল ভগ্ন দশা
লালন বলে হয় কী দশা
উজাইতে ভেটে নে প’ল তরী।।

২৩ পৌষ ১৪১৮।

********************

          ৫০।

লীলার যার নাইরে সীমা
কোন চলে সে কোনরূপ ধরে
সাঁইর লীলা বুঝবি ক্ষ্যাপা কেমন করে।।

সাঁই আপনি ঘর আপনি ঘরী
আপনি করেন রসের চুরি ঘরে ঘরে
ক্ষণেক করেন ম্যাজেষ্টারি
আপন পায়ে বেড়ী পড়ে।

গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল হয়
গর্তে গেলে কুপজলই কয় বেদেবিচারে
তেমনি সাঁইজীর অনন্তধারা
জানায় পাত্র অনুসারে।

এক হৈতে অনন্ত ধারা
তুমি আমি নাম বেওয়ারা ভবের ‘পরে
ফকির লালন বলে আমি কে তাই
জানলে ধাঁধা যেত পুরে।।

২২ পৌষ ১৪১৮।

********************

          ৪৯।

রাসুল রাসুল বলে ডাকি
রাসুল নাম নিলে বড় সুখে থাকি।।

মক্কায় গিয়ে হজ্ব করিয়ে
রাসুলের রূপ নাহি দেখি
আবার মদিনাতে গিয়ে রাসুল
মইরেছে তার রওজা দেখি।

কুল গেল কলঙ্ক হৈল
আরকিছু নাই দিতে বাকি
আমার দ্বীনের রাসুল মারা গেলে
কেমন করে ত্বয়রে থাকি।

আয়াতুল মুরছাল্লিন বলে
কুরানেতে লেখা দেখি
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় অবোধ লালন
রাসুল চিনলে আখের পাবি।।

২২ পৌষ ১৪১৮।

********************

           ৪৮।

আমি অপার হয়ে বসে আছি
পারে লয়ে যাও আমায়।।

আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে
আমি তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়।

নাই আমার ভজন সাধন
চিরদিন কুপথে গমন
আমি নাম শুনেছি পতিতপাবন
তাইতে দেই দোহাই।

অগতির না দিলে গতি
ঐনামের হবে অখ্যাতি
ফকির লালন কয় অকূলের পতি
কে বলবে তোমায়।।

২০ পৌষ ১৪১৮।


*****************

           ৪৭।

মিলন হবে কতদিনে
আমার মনের মানুষেরও সনে।।

চাতক পোহায় অহর্নিশি
চেয়ে আছে কাল শশী
হব বলে চরণদাসী
ও তা হয় না কপাল গুণে।

মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন
লুকালে না পাই অন্বেষণ
কালারে হারায়ে তেমন
ঐরূপ হেরি এদর্পণে।

যখন ঐরূপ স্মরণও হয়
থাকে না লোক লজ্বার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
প্রেম যে করে সে জানে।।

২০ পৌষ ১৪১৮।

********************

          ৪৬।

হাওয়া দমে দেখ তারে আসল ব্যাঙ্গা
কে বানাইলো এমন রংমহলখানা?

বিনা তেলে জ্বালায় বাতি
দেখতে যেমন মুক্তা মতি
ঝলক দেয় তার চতুর্বিধি
মধ্যখানা।

তিল পরিমাণ জায়গায় সে যে
হরদ রং তাহার মাঝে
কালায় গুনে আঁধলায় দেখে
লেংড়ার নাচনা।

যে করেছে এই রংমহল
না জানি তার রূপটি কেমন
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় নাইরে লালন
নাইরে নাই তার তুলনা।।

১৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

           ৪৫।

সত্য পথে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তানা না না
জাত গেলো জাত গেলো বলে
একি আজব কারখানা।।

আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবে যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না।

ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি
একি জলে সবাই শুচি
দেখেশুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।

গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এ ভ্রমতো গেলো না।।

১৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

              ৪৪।

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতির কিরূপ
দেখলাম না এই নজরে।।

কেউ মালা কেউ তসবী গলে
তাই কিরে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিংবা আসার কালে
জাতির চিহ্ন রয় কারে।

খৎনা/সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী লোকের কী হয় বিধান
ব্রাহ্মণ চিনতে পৈতে প্রমাণ
ব্রাহ্মণি চিনি কিসেরে।

জগত বেড়ে জাতির কথা
বলে বেড়াই যথা তথা
লালন কয়রে জাতির ফাতা
ডুবাইছি সাতবাজারে।।

১৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

          ৪৩।

আমার স্বভাবে সেই ভাবছি বসে
হারিয়ে গেল বুদ্ধি বল
বার তাল উদয় হল
না চিনে কোন তাল।।

কেউ বলে শেরেক ছাড়
বেহেস্তে ফল পাবা ধর
আবার কই তারা দেয় ইশারা
বেহেস্তের বৈ আছে ফল।

কেউ বলে খিরিষ্টানি
ঐ ধর্ম সত্য জানি
আমার কৈ খুদা ভজগে সদা
মুক্তি পাবি পরকাল।

না হইলো শরিয়তি
না হইলো মারিফতি
ফকির লালন বলে আখেরকালে
হতে হোল দায়মাল।।

১৯ পৌষ ১৪১৮।

*********************

           ৪২।

সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার
মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।।

নদী কিংবা বিল বাওর খাল
সর্বস্থলে একি এক জল
একা মেরে সাঁই পেয়ে সর্বঠাই
মানুষ মিশিয়া হয় বেদান্তর।

নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে
আকার সাকার রূপ ধরে সে
যেজন দিব্য জ্ঞানী হয় সেই জানতে পায়
কলির যুগে হলেন মানুষ অবতার।

বহু তর্কে দিন বয়ে যায়
বিশ্বাসের ধন নিকটে রয়
সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে
কুতর্কের দোকান খুলিসনা।।

১৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

           ৪১।

মনের হোল মতি মন্দ
তাইতে হলাম জন্ম অন্ধ।।

ভাব তরঙ্গে থাকি মজে
ভাব দাঁড়ায় না হৃদয় মাঝে
গুরুর দয়া হবে কিসে
মনের হোল বসুর ছন্দ।

ত্যজিয়েরে সুধা রতন
গরল খেয়ে ঘটাই মরণ
মানি না সাধু গুরুর বচন
তাই কূল হারায়ে হইরে অন্ধ।

ছেলে বুড়ো সকলে কয়
সাধু চিত্ত আনন্দময়
লালন বলে তাইতো সদাই
সাধুর মনে এত আনন্দ।।

১৮ পৌষ ১৪১৮।

********************

              ৪০।

পার হবি চুলের সাঁকো কেমন করে
একদিনও পারের ভাবনা ভাবলি নারে।।

বিনা কড়ির সওদা কেনা
মুখে আল্লার নাম জপ না
তাতে কী তোর আলসপনা
দেখি তোরে।

একদমের ভরসা নাই
কখন কী করিবে সাঁই
তখন কী দিবি দোহাই
কারাগারে।

ভাসাও অনুরাগের তরী
বসাও মুর্শিদ কাণ্ডারি
লালন কয় যার যার পারি
যাও না সেরে।।

১৮ পৌষ ১৪১৮। 

********************                                          
         
           ৩৯।

এই দেশেতে এই সুখ হোল
আবার কোথায় যাই না জানি
আমি পেয়েছি এক ভাঙ্গা তরী
জনম গেল সেঁচতে পানি।।

আর কিরে এই পাপীর ভাগ্যে
দয়াল চান্দের দয়া হবে
কতদিন এই হালে যাবে
বহিতে পাপের তরণী।

আমি বা কার কেবা আমার
প্রাপ্ত বস্তু ঠিক নাহি যার
ঐদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার
উদয় হয় না দিনমণি।

কার দোষ দেব এই ভুবনে
হীন হয়েছি ভজন বিনে
লালন শাহ কয় কতদিনে
পাব সাঁইর চরণ দুখানি।।

১৮ পৌষ ১৪১৮।

********************

          ৩৮।

কুলের বৌ হয়ে মনা
আর কতদিন থাকবি ঘরে
ঘোমটা ফেলে যাও না চলে
সাতবাজারে।।

কুলের লোভে কাজ হারাবি
কুল নিবি কি সঙ্গ করে
পস্তাবি শ্মশানে যেদিন
ফেলবে তোরে।

দিসনে আচিরকুরি
নেড়ানেড়ি হও যেরে
থাকবি ভাল পরকাল
তোর যাবে দূরে।

কুলের গৌরব যার হয়রে
কুলমান তার বাড়ায় সেরে
গুরু সদয় হয় না তারে
লালন বেড়ায় কুল চেখেরে।।

১৮ পৌষ ১৪১৮।

********************* 
            ৩৭।

তুমি এসো হে অপারের কাণ্ডারি
পড়েছি অকূল পাথারে
দাও এসে চরণধূলি।।

প্রাপ্তপদ ভুলে এবার
ভবরোগে ভুগবো কত আর
তুমি নিজ গুণে শ্রীচরণ দাও
তবেই কূল পেতে পারি।

ছিলাম কোথায় এলাম হেথায়
আবার আমি যাই যেন কোথায়
তুমি মনরথের সারথী হয়ে
স্বদেশে লও মনেরি।

পতিতপাবন নাম তোমার গোসাঞি
পাপী-তাপী তাইতে দেয় দোহাই
ফকির লালন বলে তোমা বিনে
ভরসা কারে করি।।

১৮ পৌষ ১৪১৮।

********************

           ৩৬।

কী সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা-রাতি নাই সেখানে।।

যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোর তুফানে।

রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।

লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে
মণিহারা ফনীর মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।।

১৭ পৌষ ১৪১৮।

******************** 
          ৩৫।

শুনিলে প্রাণ চমকে উঠে
দেখতে যেমন ভুজঙ্গনা
যেখানে সাঁইর বারামখানা।।

যা ছুইলে প্রাণে মরি
এজগতে তাইতে তরি
বুঝেও তা বুঝতে নারি
কীর্তিকর্মার কী কারখানা।

যেধনে উৎপত্তি প্রাণ ধন
সেই ধনের হোল না যতন
অকালের ফল পাকায় লালন
এই দুঃখের দোসর মিলল না।।

১৭ পৌষ ১৪১৮।

********************

          ৩৪।

অনায়াসে দেখতে পাবি
কোনখানে সাঁইর বারামখানা
আপন ঘরের খবর লে না।।

কমলকোঠা কারে বলি
কোন মোকাম তার কোথা গলি
সেইখানে পড়ে ফুলি
মধু খায় সে অলিজনা।

সুক্ষ জ্ঞান যার ঐক্যমোক্ষ
সাধকেরই উপলক্ষ
অপরূপ তারই বৃক্ষ
দেখলে চোখের পাপ থাকে না।

শুষ্ক নদীর শুখ সরোবর
তিলে তিলে হয় গো সাতার
লালন কয় কীর্তিকর্মার
কীর্তিকর্মার কী কারখানা।।

১৭ পৌষ ১৪১৮।

********************

            ৩৩।

দাসের পানে একবার চাওহে দয়াময়
ক্ষম ক্ষম অপরাধ
সংকটে পড়িয়ে এবার
ওগো দয়াল বারেবার ডাকি তোমায়।।

তোমার ঐ ক্ষমতায় আমি
যা ইচ্ছে তাই করো তুমি
রাখো মারো সে নাম নামি
ওগো দয়াল তোমারি এই জগতময়।

পাপী অধম তরাইতে সাঁই
পতিতপাবন নাম শুনতে পাই
সত্য মিথ্যা জানবো হেথা
ওগো দয়াল তরাইলে আজ আমায়।

কসুর পেয়ে মারো যারে
আবার দয়া হয়গো তারে
লালন বলে এ সংসারে
ওগো দয়াল আমি কি তোর কেহই নই।।

১৭ পৌষ ১৪১৮।

********************

             ৩২।

আমি ঐ চরণে দাসের যোগ্য নই
তুমি নিজ গুণে পদারবিন্দু
দেন যদি সাঁই দীনবন্ধু
তবেই তরী ভবসিন্ধু
নইলে না দেখি উপায়।।

আমি ভাব জানিনে প্রেম জানিনে
দাসী হতে চাই চরণে
ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে
সেই সে রাঙা চরণ পাই।

অহল্যা পাষাণী ছিল
চরণ ধুলায় মানব হল
লালন পথে পড়ে রইল
যা করেন সাঁই দয়াময়।।

১৭ পৌষ ১৪১৮।

*******************

              ৩১।

সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দিনের সাধন কেন করলে না।।

জান না মন খালে-বিলে থাকে না মীন জল শুকালে
কী হবে আর বাঁধাল দিলে মোহনা শুকনা।

অসময়ে কৃষি করে মিছামিছি খেটে মরে
গাছ যদিও হয় বীজের জোরে ফল ধরে না।

অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয় মহাযোগ সেদিনে উদয়
লালন বলে তাহার সময় দণ্ডে রয় না।।

১৪ পৌষ ১৪১৮।

********************

               ৩০।

মিছে দৌড়াদৌড়ি করি কার মায়ায়
আমি দেখিলাম এ সংসার ভোজবাজির প্রকার
দেখিতে দেখিতে অমনি কেবা কোথা যায়।।

কীর্তিকর্মার কীর্তি কে বুঝতে পারে
সেবা কৃতকে লয়ে কোথায় রাখে ধরে
একথা আর সুধাবো কারে
নিগূঢ় আত্মতত্ত্ব কথা কে বলবে আমায়।

যে করে এই লীলে তারে চিনলাম না
আমি আমি বলি ভবে আমি কোনজনা
মরি একি আজব কারখানা
এবার গুণে পরে কিছুই ঠাহর নাহি হয়।

ভয় ভজনা আমার দিবা রজনী
কার সাথে কোন দেশে যাব না জানি
সিরাজ সাঁই কয় ভীষণ কারগরি
পাগল হয়রে লালন যথায় বুঝতে চায়।।

১২ পৌষ ১৪১৮।

********************

               ২৯।

জগত মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই
ভক্তি দাওহে যাতে চরণ পাই।।

ভক্তিপদ বন্দ চিত্ত করে মুক্তিপদ দিচ্ছ সবারে
যাতে জীব ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে কাণ্ড তোমার দেখতে পাই।

রাঙ্গা চরণ দেখবো বলে বাঞ্ছা সদাই হৃদকমলে
তোমার নামের মিঠায় মন মজেছে রূপ কেমন তাই দেখতে চাই।

চরণের ঐ যোগ্য মন নয় তথাপি ঐ রাঙ্গা চরণ চাই
লালন বলে হে দয়াময় দয়া কর আজ আমায়।।

১২ পৌষ ১৪১৮।

********************

                    ২৮।

লয়ে গোধন গোষ্ঠের কানন চল গোকুল বিহারী
গোষ্ঠে চল হরি মুরালী।।

ওরে ও ভাই পেলে সোনা চরণে নূপুরও নিনা
মাথায় মোহনচূড়া দেনা ধরা পড় বংশীধারী।

তুই আমাদের সঙ্গে যাবি বনফল সব খেতে পাবি
আমরা মলে তুই বাঁচাবি তাই তোকে সঙ্গে করি।

যে তরাবে এ ত্রিভূবন সেই যাবে গোষ্ঠের কানন
ঠিকরে ভ্রমণ অভয় চরণ লালন ঐ চরণের ভিখারী।।

১২ পৌষ ১৪১৮।

********************

                  ২৭।

রাত পোহালে পাখি বলে দেরে খাই দেরে খাই
আমি গুরুকার্য মাথায় নিয়ে কী করি মন কোথায় যাই।।

এমন পাখি কে পোষে খেতে চায় সাগর চুষে কিরূপে যোগাই
পাখিটির পেট ভরিলে হয় আনন্দ কী করবে গুরু গোসাঞি।

আমি বলি আত্মারাম পাখি লয়রে আল্লার নাম আমি যদি মুক্তি পাই
পাখটি কথাতে হয় না রত খাব খাব রব সদাই।

আমি লালন লাল পড়া পাখি সে রইবে আড়া সবুর কিছু নাই
আমি বুদ্ধি সুদ্ধি সব হারায়ে সার করেছি পেটুক ভাই।।

১২ পৌষ ১৪১৮।

*******************

             ২৬।

শহরে ষোলজনা বোম্বেটে
করিয়ে পাগলপারা তারাই নিল সব লুটে।।

রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি চোরেরও শিরোমণি
নালিশ করিব আমি কোন সময় কার নিকটে।

ছয়জনা ধনী ছিল তারা সব ফতুর হল
কারবারে ভঙ্গ দিল কখন যেন যায় উঠে।

ছিল ধন-মাল পুরা খালি ঘর জমা করা
লালন কয় খাজনারি দায় কখন যেন যায় লাটে।।

১১ পৌষ ১৪১৮।

********************

               ২৫।

চরণ ছেড়ো না রে ছেড়ো না
দয়াল নিতাই কারো ফেলে যাবে না।।

দৃঢ় বিশ্বাস করে রে মন ধর নিতাই চান্দের চরণ
পার হবি তুফান ঐ পারে কেউ থাকবে না।

হরি নাম তরণী লয়ে ফিরছে নিতাই নেয়ে হয়ে
এমন দয়াল চাঁদকে পেয়ে চরণ কেন নিলে না।

কলির জীবকে হয়ে সদয় পারে যেতে ডাকছে নিতাই
লালন বলে মন চল যাই এমন দয়াল মিলবে না।।

১১ পৌষ ১৪১৮।

********************

               ২৪।

এমনও সৌভাগ্য আমার কবে হবে
দয়াল চাঁদ আসিয়ে আমার পার করিবে।।

সাধনের বল কিছুই যে নাই কেমন করে সেই পারে যাই
কূলে বসে দিচ্ছি দোহাই অপারও ভেবে।

পতিতপাবন নামটি তোমার তাই শুনে বল হয় গো আমার
আবার ভাবি এপাপীর ভার আর কে নেবে।

গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে রইলাম আমি চিরদিন
লালন ভাবে কী করিতে এলাম এই ভবে।।

৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

                ২৩।

এস দয়াল আমায় পার কর ভবের ঘাটে
দেখে ভবনদীর তুফান ভয়ে প্রাণ কেঁপে উঠে।।

সাধনের বল যাদের ছিল তারাই কূল কিনারা পেল
আমার বিনা কাজেই গেল কী জানি হয় ললাটে।

পাপ ও পুণ্য যতই করি ভরসা কেবল তোমারি
তুমি যার হও কাণ্ডারি ভব ভয় তার যায় ছুটে।

পুরাণে শুনেছি খবর পতিতপাবন নাম তোর
লালন বলে আমি পামর তাইতে দোহাই দি বটে।।

৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

                 ২২।

রূপকাষ্ঠের এই নৌকাখানি নাই ডুবার ভয়
পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়।।

বেশরা নেয়ে যারা তুফানে যাবে মারা একি ধাক্কায়
কী করবে তার বদরগাজী থাকবে কোথায়।

নবী না মানে যারা মোহাহেদ কাফের তারা এই দুনিয়ায়
ভজনে তার নাই মুজুরি দলিলে সাফ লেখা রয়।

যেই মুর্শিদ সেই রাসুল তাহাতে নাই কোন ভুল
আহাম্মদের রূপে এবার খোদাও সে হয়।

লালন কয় না এমন কথা
কুরানে কয়।।

৯ পৌষ ১৪১৮।

********************

               ২১।

কোথা যাই মন আমার কিসে বোঝাই
আমার মনচোরারে কোথা পাই।।

নিষ্কলঙ্ক ছিলাম ঘরে কিবা রূপ নয়নে হেরে
এখন প্রাণেতো আমার ধৈর্য নাই
সে চাঁদ বটে কি মানুষ দেখে হলাম বেহুশ
থেকে থেকে ঐরূপ মনে পড়ে তাই।

রূপের কালে আমায় দংশিলে উঠিল বিষ ব্রহ্মমূলে
এখন কেমনে সে বিষ নামাই
বিষ গাঁঠুরি করা না যায় হরা
কি করিবে এসে কবিরাজ গোঁসাঞি।

মন জেনে ধন দিতে যে পারে
কে আছে এভাবনগরে কার কাছে এপ্রাণ জুড়াই
যদি গুরু দয়াময় এই অনল নিভায়
লালন বলে কেবল সেই তার উপায়।।

৪ পৌষ ১৪১৮।

********************

                 ২০।

আর কতদিন জানি এই অবলা প্রাণি
এ জ্বলনে জ্বলবে ওহে দয়েশ্বর
চিরদিন দুঃখের অনলে প্রাণ জ্বলছে আমার।।

দাসী মলে ক্ষতি নাই যাই হে মরে যাই
তোমার দয়াল নামের দোষ রবে রে গোঁসাঞি
আমায় দাও হে দুঃখ যদি তবু তোমায় সাধি
তোমা ভিন্ন দোহাই আর দেব কার।

ও মেঘ হইয়ে উদয় লুকালো কোথায়
পিপাসীর প্রাণ যায় পিপাসায়
আমার কী দোষেরি ফলে এই দশা ঘটাইলে
চাও হে নাথ ফিরে এখন চাও হে একবার।

আমি উডি হাওয়ার সাথ ধরি তোমার হাত
তুমি না তরাইলে কে তরাবে হে নাথ
আমার ক্ষম অপরাধ দাও হে ঐ শীতল পদ
লালন বলে প্রাণে সহে না আমার।।

৪ পৌষ ১৪১৮।

********************

                      ১৯।

এ গোকুলে শ্যামের প্রেমে কেবা না মজেছে সখী
কারো কথা কেউ বলে না আমি একা হই কলঙ্কী।।

অনেকে তো প্রেম করে এমন দশা ঘটে কারে
গঞ্জনা দেয় ঘরে পরে শ্যামের পদে দিয়ে আঁখি।

তলে তলে তলগজা খায় লোকের কাছে সতী কলায়
এমন সৎ অনেক পাওয়া যায় প্রকাশ যে হয় সেই পাতকী।

অনুরাগী রসিক হলে সে কি মানে প্রেম নাশিলে
লালন বেড়ায় ফুটকি খেয়ে ঘোমটা দিয়ে চায় আড়চোখী।।

৪ পৌষ ১৪১৮।

********************

                    ১৮।

বলি মা তোর চরণ ধরে ননী চুরি আর করব না
আর আমারে মারিস নে মা।।

ননীর জন্য আজ আমারে মারলি মা তুই বেঁধে ধরে
দয়া নাই মা তোর অন্তরে স্বল্পেতে সব গেলো জানা।

পরের ছেলে পরে মারে কেঁদে যেয়ে মাকে বলে
সেই মা জননী নিষ্ঠুর হলে কে বুঝে শিশুর ব্যাদন।

ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন চলে যাই যেথা যায় মন
পরের মাকে ডাকবে লালন তোমার ঘরে আর থাকবে না।

৩ পৌষ ১৪১৮।

********************


               ১৭।

নিগুম বিচারে সত্য তাই গেলো জানা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাবা ঠিকানা।।

নিগুম খবর নাহি জেনে কে বা সে মায়েরে চেনে
যার উপরে দুনিয়ার ভার দিলেন রাব্বানা।

পুরুষও পরওয়ারদিগার অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার
প্রকৃতি প্রবৃদ্ধি সংসার সব গেল জানা।

ডিম্বর ভিতর কে বা ছিল বাহির হইয়া কারে দেখিল
লালন বলে ভেদ যে পেল ঘুচল দিন কানা।।

৩ পৌষ ১৪১৮।

********************


                  ১৬। 

দেখ নারে পুনর্জনম কোথা হতে হয়
মরে যদি ফিরে আসি স্বর্গ-নরক কেবা পায়।। 

পিতার বীজে পুত্রের সৃজন তাইতে পিতার পুনর্জনম
পঞ্চভূতে দেহের গঠন আলেক রূপে ফেরে সাঁই।

ঝিয়ের গর্ভে মায়ের জনম এ বড় নিগুঢ় মরম
শনিতে শুক্ল হলে কুম্ভ সবি জানা যায়।

শনিতে শুক্ল হলে বিচার জানতে পারবি কে জিত কে ঈশ্বর
সিরাজ সাঁই কয় লালন এবার ঘুরে মলি কলির ঘোড়ায়।।

২ পৌষ ১৪১৮।


*******************

              ১৫।
এক ফুলের মর্ম জানতে হয়
যে ফুলে অটল বিহারী বলতে লাগে ভয়।।

যে ফুলের মধু প্রফুল্লতা ফলে তার অমৃত সুধা
এমন ফুল জগতে কয়টা জানিলে দুর্গতি যায়।

চিরদিন সেই যে ফুল দ্বীন-দুনিয়াতে মকবুল
যাতে পয়দা দ্বীনের রাসুল সে ফুলতো সামান্য নয়।

জন্মপথে ফুলের ধ্বজা ফুল ছাড়া নাই গুরু পূজা
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় এ ভেদ বুঝা লালন ভেড়োর কার্য নয়।।

২৯ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।



********************


                    ১৪। 
দেখ দেখি মন দেখতে যার ঐ বাসনা হৃদয়

লণ্ঠনে রূপের বাতি জ্বলছে সদাই।।

বাতি যেদিন নিভে যাবে ভবের শহর আঁধার হবে
সুখ পাখি তোর পালাইবে ছেড়ে সুখালয়।

রতির গিরে ফসকা মারা শুধুই কথার ব্যবসা করা
তার কি হবে রূপ নিহারা মিছে গোল বাধায়।

সিরাজ সাঁই বলেরে লালন স্বরূপে তুই দে রে নয়ন
তবেই হবে রূপ দরশন পড়িসনে ধাঁধায়।।
২৯ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।



********************
                ১৩।
সেদিন হৃদকমলে সেরূপ ঝলক দিবে

ভাবশূন্য হইলে হৃদয় বেদ পড়িলে কী ফল হয়।
ভাবের ভাবি থাকলে সদাই গুপ্তব্যাক্ত ভাব জানা যাবে
ভাবের উদয় যেদিন হবে।।

শতদল সহস্রদলও একরূপে করেছে আলো
সেরূপে যে নয়ন দিল মহাকাল সমন তার কী করিবে।

অদৃশ্য ভাবনা করা আঁধার ঘরে সর্প ধরা
লালন বলে রসিক/ভাবুক যারা ভাবের বাত্তি জ্বেলে নিত্যধামে যাবে।।

২৮ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।



********************


              ১২।

এখন আর ভাবলে কি হবে

কীর্তিকর্মার লেখাপড়া আর কি ফিরিবে।।

তুষে যদি কেউ পাড়ও দেয় তাইলে কি আর চাল বাহির হয়
মন যদি হয় তুষেরি ন্যায় বস্তুহীন ভবে।

কর্পূর উড়ে হাওয়ায় যেমন গোলমরিচ মিশায় তার কারণ
মন যদি হয় গোলমরিচ মতন বস্তু কেন যাবে।

হাওয়ার চিড়ে কথার দধি ফলার হচ্ছে নিরবধি
লালন বলে যার যার প্রাপ্তি কেন না হবে।।

২৭ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।





********************
                      ১১।

বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানা আরেক কানা মন আমার

এসব দেখি কানার হাট-বাজার।।

এক কানা কয় আরেক কানারে চল এবার ভব পারে
নিজে কানা পথ চেনে না পরকে ডাকে বারংবার।

পণ্ডিত কানা অহংকারে সাধু কানা আনবিচারে মোড়ল কানা চোগলখোরে
আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে জানে না সীমানা কার।

কানায় কানায় খোলা-মেলা বোবাতে খায় রসগোল্লা
লালন বলে মদনা কানা ঘুমের ঘোরে দেয় বা হান।।

১৯ অগ্রহায়ণ ১৪১৮। 





********************


                 ১০।

যে রূপে সাঁই বিরাজ করে দেহ ভূবনে

গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।।

শহরে সহস্র পাড়া তিনটি পদ্মার এক মাহেরা
আলেক ছুয়ার পবন খোঁড়া ফিরছে সেখানে।

জলের বিম্বু আলের উপর অখণ্ড প্রলয়ের মাঝার
বিন্দুতে হয় সিন্ধু তাহার ধারা বয় ত্রিগুণে।

হাতের কাছে আলেক/আদম শহর রঙবিরঙয়ের উড়ছে নহর
সিরাজ সাঁই কয় লালনরে তোর সদাই ঘোর মনে।।


১৭ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।




********************


                 ৯।

মিশবি যদি জাত ছেফাতে এদিন আখেরের দিনে

কররে পিয়ালা কবুল শুদ্ধ ঈমানে।।

পিলে নুরের পিয়ালা খুলে যাবে রাগের তালা
অচিন মানুষের খেলা দেখবিরে দুই নয়নে।

ধর তরি যা পারি নুরি চিনরে সেই নুর জহরি
এহি চার পিয়ালা ভারি আছে অতি গোপনে।

ফানাফি শেখ ফানাফি রাসুল ফানাফিল্লা ফানা বাকাই কুল
এহি চার মোকামে লালন ভজ মুর্শিদ নির্জনে।।

১৫ অগ্রহায়ণ ১৪১৮। 





********************


                ৮।
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।

দ্বিদলে মৃণালে সোনার মানুষ উজ্বলে
মানুষ গুরুর কৃপা হলে জানতে পাবি।

মানুষে মানুষ গাঁথা দেখ না যেমন আলেকলতা
জেনেশুনে মুড়াও মাথা তুই যাতে তরবি।

মানুষ ছাড়া মনরে আমার দেখবিরে সব শূন্যকার
লালন বলে মানুষ আকার ভজলে তরবি।।

১৪ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।


********************

             ৭।

হল না জনম ভরে তার পরিচয়
কি এক অচিন পাখি পুষলাম খাঁচায়।।

আঁখির কোণে পাখির বাসা দেখতে নারে কি তামাশা
আমার এই আঁধলা দশা কে আর ঘুচায়।

রাম রহিম বুলি বলে ধরে সে অনন্ত লীলে
বল তারে কে চিনিলে বলগো নিশ্চয় তোরা বলগো নিশ্চয়।

যারে সাথে সাথে লয়ে ফিরি তারে বা কই চিনতে পারি
লালন কয় অধর ধরি কিরূপ ধব্জায়।।

১৩ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।





********************

              ৬।

আমার হয় না রে সেই মনের মতো মন
কিসে জানব সেই রাগের করণ।।

পড়ে রিপু ইন্দ্র ভোলে মন বেড়ায় রে ডালে ডালে
দুই মনে এক মন হইলে এড়ায় সমন।

রসিক ভক্ত যারা মনে মন মিশাইলো তারা
শাসন করে তিনটি ধারা তারা পেল রতন।

কবে হবে নাগিনী বশ সাধবো কবে অমৃত রস
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় বিষে বিনাশ হলি লালন।।

১২ অগ্রহায়ণ ১৪১৮।

********************



                      ৫।


এনেছে এক নবীন গোরা নতুন আইন নদীয়াতে

বেদ-পুরাণ সব দিচ্ছে দুষে সেই আইনের বিচার মতে।।

সাতবার খেয়ে একবার স্নান নাই পূজা নাই পাপ-পুণ্য জ্ঞান
অসাধ্যের এই সাধ্য বিধান বিকাচ্ছে সব ঘাটে-পথে।

করে না সে জাতের বিচার কেবল শুদ্ধ প্রেমেরি আচার
সত্য-মিথ্যা জানবো এবার সঙ্গ-পঙ্গ জাত-অজাতে।

পেয়ে ঈশ্বরের রচনা তাই বলে কি বেদ মান না
লালন বলে উপাসনা কর দেখি মন দোষ কী তাতে।।

১৯ কার্ত্তিক ১৪১৮।   





********************
                ৪।


ধররে অধর চান্দেরে অধরে অধর দিয়ে

ক্ষীরোদ মৈথুনের ধারা ধররে রসিক নাগরা
যে রসেতে অধর ধরা থাক সচইতন্য হয়ে।।

অরসিকা হলে পরে ডুবিসনে কূপ নদীর জলে
কারণবারির মধ্যস্থলে ফুটেছে ফুল অচিন দলে
তাহে চান-চকোরা খেলে প্রেমবানে প্রকাশিয়ে।

নিত্য ভেবে নিত্যে থেকো লীলার বশে যেয়ো নাকো
সেই দেশেতে মহাপ্রলয় মায়েতে পুত্র ধরে খায়
ভেবে বুঝে দেখ মনরাই সেই দেশে তোর কাজ কি যেয়ে?

পঞ্চবাণের সিনা কেটে প্রেম যাজ স্বরূপের হাটে
সিরাজ সাঁই বলেরে লালন বৈদিক পানে করিসনে রণ
প্রাণ হারায়ে পড়বি তখন রণকোনাতে হুকরি খেয়ে।।

১৬ কার্ত্তিক ১৪১৮।





********************
             ৩।


সৃষ্টি ছাড়া কিরূপে সে সৃষ্টিকর্তা নাম ধরেছে
সব সৃষ্টি করলো যে জন তারে সৃষ্টি কে করেছে?

সৃষ্টিকর্তা বলছ যারে লা শরীক হয় কেমন করে
ভেবে দেখ পূর্বপারে সৃষ্টি করলে শরীক আছে।

চন্দ্র সূর্যু যে করেছে তার খবর কে করেছে
নীরেতে নিরঞ্জন হল নীরের জন্ম কে দিয়েছে?

স্বরূপ শক্তি হয় যে জনা কে করে তার ঠিক ঠিকানা
জাহের-বাতেন যে জানে না তার মনেতে প্যাঁচ পড়েছে ।।

আপনার শক্তির জোরে নিজ শক্তি রূপ প্রকাশ করে
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোরে নিতান্তই ভুতে পেয়েছে।।

১৩ আশ্বিন ১৪১৮ 



********************
              ২।


           
বল স্বরূপ কোথায় আমার সাধের পিঁড়ি
যার জন্যে হয়েছিরে দণ্ডধারী ।।

রামানন্দ দরশনে পূর্বভাব উদয় মনে
যাব আমি কারবা সনে সেহি পুরী।

আর কি রে এই সঙ্গ পাব মনের এ সাধ মিটাইবো
পরম আনন্দে রব সেই রূপ হেরি।

কোথায় রে নিকুঞ্জ বন কোথায় যমুনা উদয়
কোথায় গোপ গোপিনীগণ আহামরি

গৌরাঙ্গ এই দ্বীনি বলে আকুল হইলাম তিলে তিলে
লালন বলে ব্রজ লীলে কী মাধুরী।। 

১০ আশ্বিন ১৪১৮

********************
             ১।                 


কে কথা কয়রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনমভর মেলে না।।

খুঁজি যারে আসমান জমি
আমারে চিনিনে আমি
এ বিসঙ্গমের ভূমি
আমি কোন জনা সে কোন জনা?

রাম রহিম বলছে যে জন
ক্ষিতিদল কি বায়ু দশন
শুধাইলে তার অন্বেষণ
মূর্খ দেখে কেউ বলে না।

হাতের কাছে হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লি লাহোর?
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয় লালনরে তোর
সদাই মনের ঘোর গেল না।।

৯ আশ্বিন ১৪১৮   

No comments:

Post a Comment