Wednesday, June 15, 2011

নিউক্লিয়ার শক্তি।

১। নিউক্লিয়ার শক্তির অপপ্রয়োগ।

সূর্য সকল শক্তির উৎস। আগুনের ব্যবহারে মানুষের নিরাপত্তা বেড়ে যায়। কৃষি ও কৃষি সামগ্রির বহুবিধ ব্যবহারে-শিল্প সভ্যতায় শক্তির চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ।  বাষ্পচালিত যন্ত্র যোগ হয় শিল্পে। যন্ত্র শ্রমিকের কাজ করলেও এর মালিকানা থাকে পুঁজিপতিদের হাতে, যাদের লক্ষ্য হলো মুনাফা। মুনাফার মূলে হল শ্রমশক্তি। মানষের অর্জন এই আধুনিক যন্ত্র, আসলে পুঞ্জিভুত শ্রম। শ্রমশক্তি প্রাণি ও মা ধরণীর প্রতিনিয়ত আন্তসম্পর্কের ফলে নবায়িত হয়। কিন্তু যন্ত্র চলার শক্তি যোগান হবে কিভাবে?

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রাণশক্তির ফেলে আসা ধ্বংসাবশেষ বের করে আনা হয়েছে মাটির নিচ থেকে। কয়লা পুড়ার তাপে পানি ফুটিয়ে বাষ্প কাজে লাগিয়ে চলা শুরু করেছে যন্ত্র। গত দু'শবছরে তাপ ও বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার এমন বেড়েছে যে মা প্রকৃতির গর্ভে ধারণ করা সকল জীবাশ্ম জ্বালানী - কয়লা, তেল ও গ্যাস এখন প্রায় নাই এর পর্যায়ে।

বহতানদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে টারবাইন ঘুড়িয়ে জলবিদ্যুৎের বাধে ধ্বংস হচ্ছে প্রতিবেশের জীবনীশক্তি। জীবাশ্ম জ্বালানীর দহনে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ কারখানার নানান ধোঁয়া গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বৃদ্ধি করছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কৃষিতে সার-কীটনাশক, শিল্পের বর্জ্য সবমিলিয়ে দূষণের মাত্রা এমন হয়েছে যে প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে কোন না কোন জীব।

বিশ শতকের মাঝামাঝি যোগ হয় নিউক্লিয়ার শক্তি। চিকিৎসাসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় এর ব্যবহার অনেক। কিন্তু এখন বোমা ও চুল্লী বানানোই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এই শক্তির 'অ্যাটম বোমা' দ্বারা মার্কিনি ক্ষমতাসীনরা দুই লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করে। কিয়ামত নামানোর মতো ধ্বংসাত্নক এই বোমা। অনেক দেশই এখন এই বোমার অধিকারি। বোমার পরীক্ষা করে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দে'য়া হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

নিউক্লিয়ার শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করার প্রথম চুল্লী ১৯৫৬ সালে বৃটেনের উইন্ডস্কেলে চালু করার পরের বছরই আগুন ধরে। প্রথম চুল্লী দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ইউরোপ পর্যন্ত। এরপর চুল্লী বানানো থমকে ছিল বেশ কিছুদিন। ১৯৭৩ সালের তেল সংকটের সুযোগে আবার চুল্লী বানানোর আয়োজন হয়। মার্কিনিরা ১৯৭৪ সালে প্রথম অনুমোদন দেয়। ১৯৭৯ সালে পেনসিলভানিয়ার থ্রি মাইল আইল্যান্ডে চুল্লী গলে যাওয়ার মতো (বা যাওয়া) ও তার পরেই ১৯৮৬ তে রাশিয়ার চেরনোবিলের চুল্লী গলার ঘটনায় সারাদুনিয়ার মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের এলাকায়।

জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির হত্যাযজ্ঞের দাগ হৃদয়বিদারি। তেজস্ক্রিয়তায় কি ক্ষতি হয় এই বিষয়ে মানুষের কোন ধারণাই ছিলো না হিরোশিমা-নাগাসাকির আগে। তেজস্ক্রিয়তা আক্রান্ত জাপানিদের উপর চালানো পরীক্ষা-নিরিক্ষাই চুল্লীমালিকদের বা সরকারের প্রধান খতিয়ান, যা দিয়ে বিভিন্ন নিরাপত্তার কথা বলা হয়। ‘বৈজ্ঞানিক’ নিরাপত্তার দলিল ফেলে মানুষ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। মানুষের প্রতিবাদের শক্তি জোরদার হচ্ছে দিনে দিনে।

চেরনোবিলের পর ইতালিতে বিদ্যমান ৪টি চুল্লীর ভবিষ্যৎ নিয়ে গনভোট হয়। জনগণ প্রত্যাখ্যান করে পারমাণবিক শক্তি। বারলুসকনি ২০১৩ সালে নতুন করে ৪টি চুল্লী বানাতে চায়, এবং ২০১১ সালে আবারও প্রত্যাখ্যাত হয় বিপুল ভোটে।

জার্মানি জনগণের প্রতিরোধের মুখে ২০২১ সালের মধ্যে ১৭টি চুল্লীই বন্ধ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু গতবছর চুল্লীর আয়ু দশ বছর বাড়ানোর একটি আইন পাস করে কনজারভেটিভরা। ফুকুশিমার পর জনমতের চাপে জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি থেকে বের হয়ে আসার কথা ঘোষণা করে।
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশী ১০৪ টি চুল্লী। নিউক্লিয়ার শক্তি বিরোধী জনমতের কারণে গত তিন দশক ধরে নতুন চুল্লী বানানো বন্ধ। ওবামা নতুন করে কর্মসূচি ঘোষনার কথা বললেও ফুকুসিমার পর সবকিছু স্থবির হয়ে গেছে। বেলজিয়াম সুইজারল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশ সরে আসছে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ থেকে।

চুল্লী দুর্ঘটনাস্থল হাজার হাজার বছর বা চিরতরের জন্য মনুষ্য বা অনান্য প্রাণির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যায়। সজ্ঞানে মানবজাতির এমন কাজ মেনে নেয়া যায় না।

২। শক্তি উৎপাদনের ফ্রাংকেনস্টাইন নিউক্লিয়ার চুল্লী।

নিউক্লিয়ার চুল্লীতে ঘটানো হয় নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। বিক্রিয়া মানেই পরিবর্তন আর সাথে সাথে তাপশক্তির আদান-প্রদান। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৌলসমূহের কোন পরিবর্তন হয় না, কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় মৌলেরই পরিবর্তন হয়। দুইভাবে এই ঘটনা ঘটে- যখন দুই বা ততোধিক মৌল যুক্ত হয়ে একটি মৌল গঠন করে তখন বলা হয় ফিউশন, আর উল্টাভাবে, যখন একটি মৌল ভেঙ্গে দুই বা ততোধিক মৌল তৈরি করে তখন বলা হয় ফিশন। উভয় প্রক্রিয়াতেই প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তিকেই কাজে লাগিয়ে বানানো হয় পারমাণবিক বোমা অথবা বিদ্যুৎ।

গত দেড়-দু'শ বছরে তাপশক্তিকে কাজে লাগানোর তাপগতিবিদ্যার চর্চা হয়েছে প্রচুর। এ বিদ্যার মূলমন্ত্র তিনটি। প্রথম কলেমা লোকজনের মুখে মুখে- 'শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নাই, কেবল শক্তির নানা রূপে রূপান্তর সম্ভব' এই মন্ত্র 'শক্তির নিত্যতার সূত্র' নামে পরিচিত। দ্বিতীয় মন্ত্র বুঝাই যাচ্ছে শক্তির রূপান্তর সম্পর্কিত, কারণ অন্য কিছুতো সম্ভবই না। যান্ত্রিক, তাপ, আলোক, নিউক্লিয়ার,  বিদ্যুৎ এরূপ নানাবিধ শক্তির রূপান্তরের পদ্ধতি বা যন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়-'এমন যন্ত্র সম্ভব নয় যা শতভাগ তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যান্ত্রিকশক্তি বানাতে পারে'। ২০-৪০ শতাংশের বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন তাপযন্ত্র এখনও বানানো সম্ভব হয়নি। আশেপাশে তাপ শক্তির ছড়িয়ে পড়ে এবং এর থেকে পরিবেশের বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মান্ডের নাকি বিশৃংখল হওয়াটাই চিরন্তন। তাপরসায়নে বিশৃংখলা পরিমাপের জন্য -২৭৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ব্রহ্মান্ডের একটি সুষম স্ফটিককে বিশৃংখলাহীন 'প্রমাণ অবস্থা' ধরাই হলো সর্বশেষ তৃতীয় সূত্র। তাপগতিবিদ্যার এই জ্ঞান বর্তমান বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি।

মৌলের কথায় আসা যাক। হোমো স্যাপিয়েন্সের (মানুষ) সচেতনতার আবির্ভাব আর জগৎকে জানতে চাওয়া (কি!) একই সুতায় গাঁথা। পুরাকালে ভারতীয়রা পঞ্চভুতের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম) বা ভুতচতুষ্ঠয়ের (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ-চার্বাকরা) সমন্বয়ে জগৎ তৈরি বলে মনে করতো। খ্রিষ্টের প্রায় ছয়শ বছর আগে বৈশেষিক গুরু কাশ্যপ বা কণাভুক- কণাদ বিকাশ ঘটায় কণাবাদ বা পরমাণুবাদের। প্রায় একই সময়ে গ্রীসের ডেমোক্রিটাসরাও জড়িত ছিল একই চর্চায়। পরমাণুবাদের মোদ্দা কথা হলো 'জগৎ তৈরির ক্ষুদ্র এককের' ধারণা। ভারতীয়রা বলে কণা বা অণু/পরমাণু, ইংরেজরা বলে অ্যাটম (যা আর ভাংগা যায় না)। এরপর প্রায় দুইহাজার বছর এ নিয়ে তেমন নাড়াচাড়া হয় নি। উনিশ শতকের শুরুর দিকে পরমাণুবাদ পুনরায় আলোচনায় নিয়ে আসে ডাল্টন। এখন এই ধারণায় নানাবিধ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। অবিভাজ্যতার ধারণা পাল্টে পরমাণুতে খোঁজ মিলেছে তিনটি মৌল কণিকার। ঋণাত্নক (ইলেকট্রন), ধনাত্নক (প্রোটন), ও নিরপেক্ষ (নিউট্রন) আধানযুক্ত (চার্জ) তিন ধরণের কণিকার ভরও ভিন্ন ভিন্ন। পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ, পরমাণুতে ঋণাত্নক ও ধনাত্নক আধানযুক্ত কণিকা সমান। কণিকাদেরও কাটা ছেড়া করে বেরুচ্ছে কোয়ার্ক! তবে এই তিন মৌল কণিকার ধারণার উপর ভর করেই বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত জগৎকে বিশ্ল্যেষণ করে ও কাজে লাগায় নানান কারিগরিতে।

পরমাণুর রূপের সাথে মানুষের পরিচিতি পুরাকাল থেকেই। রাদারফোর্ড পরমাণুর রূপ বর্ণনায় প্রথম একে তুলনা করে সৌরজগতের সাথে। সৌরমণ্ডলের সাথে রাশিচক্রের যোগে মানুষ ও প্রকৃতির গতিবিধির জ্যোতিষ বিজ্ঞানের চর্চা ছিল ভারতে। ডিমের কুসুমের মতো সৌরজগতের কেন্দ্রে যেমন থাকে সূর্য, ঠিক তেমন পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ধনাত্নক আধানযুক্ত ও নিরপেক্ষ কণিকাসমূহের যুথবদ্ধ অবস্থান। যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে গ্রহসমূহের ন্যায় ঋনাত্নক আধানযুক্ত কণিকাসমূহ বিভিন্ন দুরত্বে সদা ঘূর্ণয়মান থাকে। দুরত্ব অনুসারে ধরা হয় বিভিন্ন শক্তিস্তর। কেন্দ্র হতে বিভিন্ন দুরত্বে ঘূর্ণয়মান এই কণিকাসমূহের শক্তিস্তরের পরিবর্তন বা আন্তঃকণিকার বিভিন্ন শক্তির গণনায় ধ্রুপদি পদার্থবিদ্যা অপ্রতুল হলে আবির্ভাব হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার (মেকানিক্স)। বস্তু ও শক্তির ভিতর সম্পর্কায়ন করে সাড়া ফেলে দেয় আইনস্টাইন।

মূলত চার ধরণের শক্তি- মহাকর্ষ, তড়িৎচুম্বকীয়, শক্তিশালী আন্তনিউক্লিয়ার ও দুর্বল আন্তনিউক্লিয়ার শক্তি আছে জগতে। সব শক্তিই এক শক্তি একথা বলার সাধনায় আছে অনেকে। তড়িৎচুম্বকীয় ও দুর্বল আন্তনিউক্লিয়ার শক্তি একীভুত করে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পায় আব্দুস সালাম।

পরমাণুতে ধনাত্নক কণিকার সংখ্যা ১ হতে শুরু করে শতাধিক পর্যন্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু তৈরি করে। তবে এর মধ্যে ৮৮টি স্থায়ী প্রাকৃতিক মৌল বাকিগুলো প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম অস্থায়ী মৌল। অস্থায়ী মৌল মানেই তেজষ্ক্রিয় মৌল। নিউক্লয়াসের ধনাত্নক ও ঋণাত্নক কণিকার অনুপাতের হেরফেরের কারণে যখন কোন মৌল ভেঙ্গে যায় তখনই নির্গত হয় আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। ভিন্ন ভিন্ন শক্তি ও ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই রশ্মিসমূহই ছড়ায় তেজস্ক্রিয়তা।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া। ইউরেনিয়াম-২৩৫ মৌলকে (যা একটি তেজষ্ক্রিয় মৌল) চুল্লীর ভিতর পরমাণুর নিরপেক্ষ কণিকা (নিউট্রন) দ্বারা আঘাত করলে বিভিন্ন প্রকার ফিশন উৎপাদ যেমন নেপচুনিয়াম, প্লুটুনিয়াম, অ্যামরেসিয়াম ইত্যাদি ও প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। ২৩৫ গ্রাম ইউরেনিয়াম থেকে ফিশনের মাধ্যমে প্রায় ২০ টেরা জুল শক্তি উৎপন্ন হয়। ২০ টেরা জুল শক্তি মানে প্রায় ৭৫ লক্ষ ঘোড়া এক ঘন্টায় যে পরিমাণ কাজ করতে পারে। কিন্তু মাত্র ৪% ইউরেনিয়াম শক্তি উৎপাদনে কাজে লাগে বাকি ৯৬% চলে যায় বর্জ্যের সাথে। আর তাপগতিবিজ্ঞান থেকে আমরা জানি যে মাত্র এক তৃতীয়াংশের মতো তাপকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগাতে পারি বাকিটা ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে।

ব্যাপক এ্ই তাপশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পানি চালনা করে শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয় সার্বক্ষনিক। তাপের সাহায্যে পানি গরম করে উৎপাদিত বাষ্পের দ্বারা ঘুরানো হয় টারবাইন। তৈরি করা হয় বিদ্যুৎ।

শক্তি উৎপাদনের এই ফ্রাংকেনস্টাইন মানুষের জন্য বহু দুর্যোগ নিয়ে এসেছে এবং নানান অজানা দুর্গতি অপেক্ষা করছে মানুষ ও আমাদের প্রিয় এই আবাসের জন্য।


No comments:

Post a Comment