প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে সিন্ধু নদের উপত্যকায় ভারতবর্ষের মানুষেরা গড়ে তুলেছিল এক কৃষি সভ্যতা। নদীর দু'ধারে বন্যার পানি ও সতত বহমান পানিকে কাজে লাগিয়ে চাষ করতো গম আর বার্লি। কৃষির উদবৃত্তের কারণে কিছু মানুষ শৈল্পিক কাজের সুযোগ পেয়ে মৃৎ শিল্পে চরম উৎকর্ষতা অর্জন করে। এর বদৌলতে দজলা ফোরাতের কূলে মেসোপোটেমিয়া ও নীলের বুকে মিশরীয়দের সাথে তৈরী হয় আন্তঃসম্পর্ক। পণ্যের আদান-প্রদানের সুবিধার্থে তৈরি হয় বিভিন্ন রকম চিহ্ন ও লিপি। নানা ধরণের আচার ও লিপি সম্বলিত সীল পাওয়া গেছে হরোপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে। এসব পুরাকীর্তিতে সাক্ষর বহন করছে শিব ও কালির ধারণা।
কৃষি সভ্যতার বাস্তবতায় ফসল ঘরে তোলা ও বীজ বপণের এই চক্রে যে মিথ তৈরি হয় তাতে মৃত্যু বা ধ্বংস ও প্রজনন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই দু'য়েরই সমন্বয়ের যে অজানা মহাশক্তি তাই শিব। মহাদেব শিবের আবাস হলো হিমালয়ের তিব্বত মালভূমির কৈলাস শৃঙ্গে। পৌরাণিক কৈলাসকে ভারতীয়রা মনে করতো পৃথিবীর কেন্দ্র। এর চারদিক থেকে চারটি নদী সিন্ধু, সেতলুজ, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা প্রবাহিত। সিন্ধুর কোলে ভারতীয়দের প্রথম সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ম্লান হয়ে আসতে থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা সিন্ধুর গতিপথের পরিবর্তন বা বহির্শত্রুর আক্রমণ অথবা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগই এর পতনের কারণ। একই সহস্রাব্দের মাঝের দিকে কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চল থেকে ধাতু হাতে রথে চড়ে পশুপালের পিছে পিছে ভারতে আসে আর্যরা। এই সময়ই সিন্ধুর লোকেরা অসহায় হয়ে নতুন আবাসের খোঁজে নজর ফেরায় মা গঙ্গার কোলে। ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত এই অববাহিকা সদ্য পাওয়া ধাতুর দা কুড়াল নব দিগন্ত খুলে দেয় ভারতীয়দের।
মানস সরোবর থেকে বইতে বইতে প্রথমে হস্তিনাপুর তারপর মগধের আলোচিত দু'টি প্রাচীন সভ্যতার গোড়া পত্তন করে দুনিয়ার সবচে' বড় বদ্বীপ বঙ্গ গড়ে গিয়ে গঙ্গা সাগর সঙ্গমে মিলায় পূর্ব সাগর তথা বঙ্গোপসাগরে। গত চার পাঁচ হাজার বছর ধরে এ অববাহিকায় কোটি কোটি মানুষ জীবন ধারণ করছে ধান গম আর কাউন চাষ করে। গ্রীকদের কাছে গঙ্গাঋদ্ধি নামে পরিচিত বঙ্গের জীবন জীবিকাই মূলত গঙ্গার পলি বাহিত জল দু'কূল ছাপিয়ে উঠলে তাতে ধানের চাষ। নদী ও জলাভূমির এই বঙ্গের মাছে ভাতে মানুষদের জীবন সবসময়ই সংগ্রাম মুখর। নদী-ভাঙ্গন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড, ও জলোচ্ছাসের সাথে লড়াই, আর বাইরে থেকে আসা লুটেরাদের লুটপাটে কখনও স্বস্তি পায়নি এই জনপদের মানুষ।
পলি গঠিত ভঙ্গুর এই দ্বীপে শত শত নদীর গতিপথ যখন যেমন খুশী বয়ে চলে। সাগরকে কাছে পেয়ে মাতাল নদীর এমন আচরণের কারণে অতীত সভ্যতার নজীর খুব একটা নেই এই বাংলায়। মোঘল আমলের আর্থিক নথি 'আইন-ই-আকবরী'তে দেখা যায় মোঘলদেরকে সবচে' বেশী কর দেয়া একটি জনপদ এই বাংলা। মোঘলদের ধান, তুলা, মসলিন আর নৌ শিল্পের নিপুণতা দান করেও এ দেশের মানুষ ছিল অনিরাপদে। বার বার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে বলে মোঘলরা নাম দিয়েছে বলগাগপুর (বিদ্রোহের নগরী)। ব্রিটিশরা বাংলার পাট দিয়ে ডান্ডি বানিয়ে দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে তাবৎ দুনিয়া। কলুর বলদের মতো খেটে যাওয়া এই জনপদের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি মেলেনি।
ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য কতকিছুই না করেছে এই মানুষেরা। বৃহত্তর হিন্দু বলয়ের নিচের জাতের মানুষ আখ্যা নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে ধান তুলা ইত্যাদি চাষ করে পুষ্টি যুগিয়েছে উপর তলার মানুষদের। কথা চালু আছে, বাংলায় নাকি কোন ব্রাহ্মণ নাই। ব্রাহ্মণরা বাংলায় আসতে চাইতেন না। তাতে এই ম্লেচ্ছদের সংস্রবে নাকি নষ্ট হবে তাদের পবিত্রতা! এমন হিন্দু হয়ে আর কি লাভ। তাই অশোকের পর থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বুদ্ধের দুনিয়াজয়ী বাণী 'জগৎ দুঃখময়' এর তলে আশ্রয় নিয়ে মানুষ বৌদ্ধ হয়েছে। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চুপচাপ নির্বাণ লাভের চেষ্টা করার মতো শক্ত ভূমিই নয় এই বাংলা। যে সমস্ত শক্ত ভূমি তথা পাহাড়ী এলাকায় বু্দ্ধের বাণী বিস্তারিত হয়েছে সেসব অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান আজও দৃঢ়। ১৩ শতকের শুরুতেই সেনাপতি খলজি বাংলা দখল করলে আরবীয় ইসলামী মতাদর্শের গোড়াপত্তন হয়। ১২৫৮ সালে হালাগুর হাতে আব্বাসীয়দের পতন হলে মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র সরে আসে পার্সো-তুর্কীদের দখলে। তুর্কীরা পার্সিয়ান সুফীদের হাতে মুসলমান হওয়ায় ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতার শক্তিশালী ভাগিদার হয় এই সুফীরা। রাজা ও সুফী উভয়ই একই শাহ উপাধি ব্যবহার করতো। ১৭ শতকের আগ পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ শাসকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মূলকেন্দ্র ছিল লক্ষণাবতী, পান্দুয়া ও গৌড়সহ বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ বা বলা চলে গঙ্গা হুগলি ভাগিরথী অঞ্চল। ১৬ শতক থেকে পদ্মার ধারায় নতুন নতুন কৃষি জমি উন্মোচিত হয়। ঝাকে ঝাকে ক্ষুদে কৃষক প্রতুলের গানের কথার মতো সাপের মাথায় পা দিয়ে বাস করতে থাকে এসব অঞ্চলে। শাসকরা মুসলিম হওয়ায় তাদের উদার অংশ সূফীদের হাতে এরা হয়ে যায় মাজারকেন্দ্রিক মুসলমান। পাঠান মোঘল ও ইংরেজদের শাসনের ভিতর দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানের বিভাজন জোরদার হয়েছে ভারতবর্ষে। ১৯৪৭ এ ধর্মের ভিত্তিতে দু'টি রাষ্ট্র হয় ভারত ও পাকিস্তান। মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় জমিদারী উচ্ছেদের সাথে একমত হলে এ অঞ্চলের মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনে। ঘোর ভাংতে সময় লাগেনি ১৯৭১ সালেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
ষাটের দশক থেকেই মা গঙ্গার মূল ধারা পদ্মা থেকে সরিয়ে হুগলি ভাগিরথীর দিকে নে'য়ার পরিকল্পনা হাতে নেয় ভারত। পাকিস্তানের সাথে আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলার মায়ের গলায় ফাঁস লাগিয়েছে ভারত।
মা গঙ্গার আরেক নাম জাহ্নবি। বলা হয়ে থাকে জাহ্ন নামে এক ঋষি নবাবগঞ্জের গঙ্গা ও মহানন্দা নদীর মিলনমুখে তপস্যায় বসেছিলেন, কিন্তু গঙ্গাস্রোত এসে তছনছ করে দেয় তার সবকিছু। ক্ষিপ্ত হয়ে যান জাহ্ন। তিনি গঙ্গার সব পানি খেয়ে ফেলেন। তারপর জাহ্ন শান্ত হলে তার পায়ের রান কেটে পানির প্রবাহ তৈরি করেন। তখন থেকে মা গঙ্গাকে জাহ্নবিও বলা হয় অর্থাৎ জাহ্নর সন্তান।
এছাড়াও মহাভারতের গল্পে ভারত বংশের শান্তনুর সময় তিনি হঠাৎ দেখেন গঙ্গায় কারা জানি বাধ দিয়েছে, তিনি নিজেই খু্ব্ধ হয়ে বাণ নিয়ে দৌড়ে যান ঘটনাস্থলে। সেখানে উপস্থিত ছিল মা গঙ্গা ও তার পুত্র ভীষ্ম। মা গঙ্গা শান্তনুকে বলেন তোমার পু্ত্রই আমাকে রক্ষা করতে পারবে। পরশুরাম শিস্য গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের বাণে বালুর বাধের মতো ভেঙ্গে পড়ে সেই বাধ।
এই দু'টি মিথ থেকে একথা স্পষ্ট যে গঙ্গায় বাধ আগেও দেয়া হয়েছে এবং সে বাধ কখনও মঙ্গল বয়ে আনে নি। মা ভাগিরথী হয়ে না পদ্মা হয়ে সাগরে যাবেন তা মাই ভাল জানেন। তবে মার স্বাভাবিক গতি বাধাপ্রা্প্ত হলে তাকে মুক্ত করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। আর গত চার দশকে এটা প্রতীয়মান যে এই ফারাক্কা 'দু'বাংলার' জন্যই ক্ষতিকর। মাকে না বাঁচাতে পারলে আমরা বাঁচবো না।
No comments:
Post a Comment